স্বাস্থ্য (Health) :
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক সুস্থতাকেও বুঝায়। অথচ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা হল, তারা মনে করেন কোনপ্রকার রোগব্যাধি না থাকা অর্থাৎ কেবল শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাই হল সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ।
WHO(World Health Organization) অনুযায়ী স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা হল : "Health is a state of complete physical, mental and social well-being and not merely an absence of disease or infirmity, so that each citizen can lead a socially and economically productive life. "
অর্থাৎ, স্বাস্থ্য হল সম্পূর্ণভাবে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা। কেবল রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়, যাতে করে একজন নাগরিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জীবনযাপন করতে পারে।
সুতরাং একজন ব্যক্তিকে তখনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যাবে যখন সে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও ত্রুটিমুক্ত থাকবে।
⬛ প্রথমেই শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু বিষয় তুলে ধরা হল:
🔹শারীরিক স্বাস্থ্য : শারীরিক স্বাস্থ্য বলতে শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করাকে বোঝায়। যেকোন প্রকার রোগের লক্ষণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, স্বাভাবিক কাজকর্ম ঠিকমত করতে পারে এবং যার কোন কাজে কোনপ্রকার অসুবিধা হয়না, তাকেই শারীরিকভাবে সুস্থ ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সব কাজ সঠিকভাবে করার জন্য শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে আমাদেরকে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে-
▪️একজন ১৮-৩০ বছর বয়সী ব্যক্তি যার উচ্চতা ১.৭৩ মিটার (৫ ফিট ৮ ইঞ্চি) তার স্বাভাবিক ওজন হওয়া উচিত ৬০-৬৫ কেজি। তাহলে তার BMI হবে ২০ (BMI এর পূর্ণরুপ হল Body Mass Index) এবং এর দ্বারা একজন মানুষের উচ্চতা অনুযায়ী তার ওজন কেমন হওয়া উচিত তা নির্দেশ করে আর এর আদর্শ মান হল: ১৮.৫-২৪.৯।
কারো বিএমআই ১৮.৫ এর কম হলে তাকে আন্ডারওয়েট/কম ওজন আর ২৪.৯ এর বেশি হলে তাকে ওভারওয়েট/বেশি ওজনের ব্যক্তি হিসেবে ধরা করা হয়। ৩০ এর উপরে গেলে সেটাকে স্থুলতা বলে। এই মান যার যত বেশি হবে তার হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি ততই বাড়তে থাকে।
BMI নির্ণয় করার সূত্র হল: দেহের ওজন(কেজিতে)/ উচ্চতা (মিটার×মিটার)।
এই সূত্র দিয়ে যে কেউ সহজেই নিজের ওজন ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে পারে।
▪️এছাড়া সময়ের সঠিক ব্যবহার, যেমন দৈনিক ২৪ঘন্টার মধ্যে অন্তত ৮ ঘন্টা ঘুমানো, ৮ঘণ্টা মাঝারি ধরনের কাজকর্ম, কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি, ইবাদত আর কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার মাধ্যমে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব।
▪️শারীরিক সুস্থতার জন্য নিয়মিত সুষম খাবার (ভাত,রুটি,ডাল,ডিম,দুধ,ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি) এবং পানির কোন বিকল্প নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং কর্মক্ষম মানুষের দৈনিক ২-৩লিটার পানি পান করা উচিত।
Tamanna
Tamanna Tabassum
🔹মানসিক স্বাস্থ্য : শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ এবং আশপাশের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে।
মানসিক স্বাস্থ্য সামগ্রিক স্বাস্থ্যের-ই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মানুষ শারীরিক সুস্থতাকে যতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখে মানসিক সমস্যাকে ততটা গুরুত্বের সহিত দেখেনা।
অথচ সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭% বা ২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন ভুগছেন বিষণ্ণতায়। অথচ অবাক করা বিষয় হল, এর ৯২%-ই রয়েছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে।
অন্যদিকে ১৩.৬% শিশুও মানসিক রোগে ভুগছে বলে জরিপে উঠে এসেছে, যাদের ৯৪% কোন চিকিৎসা পাচ্ছে না।
এর কারণ হিসেবে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, "যেকোনো শারীরিক রোগকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলেও মানসিক সমস্যাকে বাংলাদেশে এখনও ঠাট্টা, বিদ্রূপ বা হালকা বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয়।"
মানসিক সমস্যা প্রকট আকার না নেয়া পর্যন্ত বেশিরভাগই চিকিৎসকের কাছে আসতে চান না।
তিনি আরও বলেন, "আমাদের এখানে মানুষ তখনই ডাক্তারের কাছে আসে যখন পরিস্থিতি অনেক গুরুতর। কেউ আছেন যারা কুসংস্কারের কারণে আসতে চান না। আবার অনেকে জানেনই না যে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।"
(Source: BBC bangla)
মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব :-
সুস্থ ও সুন্দর জীবনের জন্য শরীরকে সুস্থ রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হল মনকে সুস্থ রাখা। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সে –
ক) দৈনন্দিন কাজকর্ম সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
খ ) বিভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
গ ) পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে চলতে পারে। স্বাভাবিক ও সুষ্ঠ অভিযোজনে সক্ষম হয়।
ঘ ) বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ঙ ) আরও উৎপাদনশীল হয়ে ওঠে এবং নিজের ও সমাজের উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।
▪️মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায় :-
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আমরা যা যা করতে পারি –
১) নিজের যত্ন নেওয়া।
২) পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ।
৩) পর্যাপ্ত ঘুম।
৪) নিয়মিত ব্যায়াম।
৫) শখের কাজ করা।
৬) নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা।
৭) কৃতজ্ঞ থাকা।
৮) ক্ষমা করার মানসিকতা তৈরি করা।
এ উপায়গুলো আমাদের নাগালের মধ্যে রয়েছে যা অবলম্বন করে আমরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি, তবে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা নিরাময়ের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া জরুরি। আমাদের চারপাশে রোজ কিছু নৃশংস ঘটনা ঘটছে, যারা ভুক্তভোগী তাদের মধ্যে সাংঘাতিক মানসিক চাপ, ভয়, বিষন্নতা, হতাশাসহ নানাধরণের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমাদের উচিত তাদের পাশে থাকা, তাদেরকে হেয় চোখে না দেখে কিভাবে তারা পুরোপুরি সুস্থ জীবন পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
🔹সামাজিক স্বাস্থ্য :
সামাজিক সুস্থতা বলতে একজন মানুষ সমাজের সাথে কতটা ভালোভাবে মিশতে পারে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে কতটা স্বেচ্ছায় আগ্রহী তাকেই বুঝায়।
▪️সামাজিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য আমরা যা যা করতে পারি তা হল:
Tamanna
Tamanna Tabassum
১. সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমন - সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করা।
২. সমাজে বসবাসরত অন্যান্যদের মতামতকে সম্মান করা এবং তাদের যেকোনো সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া।
৩. পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৪. নিজের এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
৫. সমাজ থেকে খুন, ধর্ষণ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে পদক্ষেপ নেয়া।
৬. সমাজের সকল মানুষকে স্বাস্থ্যসচেতনতা বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা দেয়া।
৭. "সকলের জন্য শিক্ষা", এই মর্মে কাজ করা।
অতএব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটাও জরুরি , কেননা এটিও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সর্বোপরি বলা যায় একটি সুখী-সমৃদ্ধ এবং কর্মক্ষম জীবনযাপনের জন্য শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন বিকল্প নেই। অতএব সকলের উচিত স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা।