নিজ দেশ মিয়ানমারে ২০১৭ সালে সংঘটিত গণহত্যার বিচার দাবি ও পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন দাবিতে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। গতকাল সকাল সোয়া ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত উখিয়া-টেকনাফের ২০টি ক্যাম্পে পৃথকভাবে এই মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। ‘গো ব্যাক হোম’ প্রতিপাদ্যে চলমান মানববন্ধনে নানা দাবি নিয়ে বক্তব্য রাখেন ক্যাম্প ও ব্লকভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গাদের একবাক্যের দাবি- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। কথা ছিল সমাবেশ নয়, শ’খানেক রোহিঙ্গা মানববন্ধন করতে পারবেন। কিন্তু নিপীড়নের বিচার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানববন্ধনে জড়ো হয়ে যান হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এতে মানববন্ধনগুলো সমাবেশে রূপ নেয়। সেখানে তারা ২০১৭ সালে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা, ধর্ষণসহ নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে প্রত্যাবাসন কামনা করেন। এ সময় তাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
বিজ্ঞাপনরোহিঙ্গা নেতারা বলেন, আমরা বিশ্ববাসীর কাছে দাবি জানাচ্ছি আমাদের ২০১৭ সালের গণহত্যার বিচার করুন, মা-বোনদের ধর্ষণের বিচার করুন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করুন। আর আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমাদের সহায় সম্বল ফিরিয়ে দিন। সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচার, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবিসহ নানা দাবিতে সোচ্চার ছিলেন সমাবেশে অংশ নেয়া রোহিঙ্গারা।
সমাবেশে মোনাজাতকালে রোহিঙ্গাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মানববন্ধন, সমাবেশ শেষে পৃথকভাবে মিছিল করে রোহিঙ্গারা। এ ছাড়াও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, পালংখালী, থাইংখালীর তাজনিমারখোলাসহ ২০টি ক্যাম্পে এ সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে। ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ এপিবিএন’র উপ- অধিনায়ক কামরান হোসেন বলেন, ‘আমার অধীন ১৬, ১৩ নম্বর ক্যাম্পসহ ১১টি ক্যাম্পে ২০টি পৃথক স্থানে রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। মানববন্ধনে নিরাপত্তা জোরদার ছিল।’ উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হওয়ার ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে। এর আগে, ২০১৯ সালের ২৫শে আগস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এবারের সমাবেশে কেউ নেতৃত্বে ছিলেন না। কমিউনিটি নেতারাই রোহিঙ্গাদের জড়ো করান। বিচার চেয়ে রোহিঙ্গা নারী- পুরুষের অঝোর কান্না মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন, সহিংসতা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যার আজ ৫ বছর। এদিনটিকে রোহিঙ্গারা কালোদিবস আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। সকাল থেকে লোকজন কুতুপালং খেলার মাঠে জড়ো হতে শুরু করে।
সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী, শিশুরাও যোগ দেন। পোস্টার, প্ল্যাকার্ডে গণহত্যা ও দমন-পীড়নের বিচার ও অধিকার সহকারে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলেন রোহিঙ্গারা। সমাবেশে মোনাজাত পরিচালনা করা হয় । মোনাজাতকালে বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুরা। এদিকে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছরে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শোয়াইব, মাস্টার নুরুল আমিন, মাস্টার জুবায়ের, মোহাম্মদ ইউসুফ, মাস্টার কামাল প্রমুখ। সমাবেশে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘আজকে ‘গণহত্যা’ দিবস পালন করেছি। কারণ এদিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার আমাদের ‘গণহত্যা’ করেছে। আমরা রিফিউজি হয়ে থাকতে চাই না। এখন সোনালি আরকানে ফিরতে চাই। জান্তা সরকার আমাদের নিধন করতে ৫ বার বিতাড়িত করেছে মিয়ানমার থেকে। প্রতিবারই মানবিক বাংলাদেশ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে ধন্যবাদ জানাই।’ উল্লখ্য, ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলের মংডু, বুচিথং ও রাসেথং জেলার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। সে সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তখন সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়।
ওই দিনটিকে স্মরণে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ‘রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেমবার ডে’ পালন করে আসছে। রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরতে চায় ২৫শে আগস্ট। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার ৫ বছর। রোহিঙ্গারা এদিনটিকে ‘গণহত্যা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই এদিনে রোহিঙ্গারা মসজিদ-মাদ্রাসায় ও ঘরে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করেছিল। গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে রোহিঙ্গা নেতারা কর্মসূচি হাতে নিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি না থাকায় টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে পালন করতে পারেনি। তবে উখিয়া উপজেলার কয়েকটি ক্যাম্পে কর্মসূচি পালন করেছে। গতকাল সকালে টেকনাফ উপজেলার শালবাগান (নং-২৬) ও জাদিমুরা (নং-২৭) রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্মড্ পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা প্রতিটি পয়েন্টে নিয়োজিত। ক্যাম্পের অভ্যন্তরেও টহল জোরদার রয়েছে। শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প- ২৬ এ বসবাসকারী আনজুল হোসেন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, বিগত ৫ বছরে ছোট্ট কুটির ঘরে দুঃখ দুর্দশায় জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছি। অবাধ চলাচল আর জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা পেলে স্বইচ্ছায় দেশে যেতে আগ্রহী। এভাবে বার বার মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন নিপীড়নে এদেশে আসতে চাই না। তাই নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবি জানাচ্ছি। একই ক্যাম্পের ফয়েজুল ইসলাম জানান, নিজ ঘরবাড়ি ফেরত, রোহিঙ্গা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি, মগদের মতো অবাধ চলাচলের অধিকারসহ সকল সুযোগ-সুবিধা দিলেই এখনই মিয়ানমার থেকে যেভাবে এসেছি সেভাবেই ফিরে যাবো। ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) বজরুল ইসলাম বলেন, গণহত্যা দিবস পালন করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে অনুমতি না পাওয়া কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছেনা।
তিনি জানান, ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করতে চাই না। এ জীবন আমাদের কাম্য নয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দ্বারা ১৮ হাজার নারীকে ধর্ষণ, ২৫ হাজার মৃতদেহের সন্ধান, সেখানকার কারাগারে শতাধিক রোহিঙ্গাকে পিটিয়ে হত্যা, ৭৫ হাজার বাড়িঘর ও ৭২ হাজার দোকান পুড়িয়ে দেয়। এসব নির্যাতনের কারণে পালিয়ে আসতে হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গা নেতারা দাবি করেন, ২০১৭ সনে সেনাদের হাতে ১০০ নারী ধর্ষিত, ৩০০ গ্রাম নিশ্চিহ্ন, ৩৪ হাজার শিশুকে এতিম, ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা, ৯ হাজার ৬০০ মসজিদ, ১২০০ মক্তব, মাদ্রাসা ও হেফজখানায় অগ্নিসংযোগ, আড়াই হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে বন্দি ও ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আরাকান রাজ্য থেকে বাস্তচ্যুত হয়। এদিকে রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের ভোগান্তি দিন দিন চরমে পৌঁছেছে। সর্বদা আতঙ্কের পাশাপাশি কর্মসংস্থান দখলে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। ক্যাম্পে খুন, গুম, মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।
রোহিঙ্গাদের এই কারণে দিন দিন ফুঁসে উঠছে স্থানীয়রা। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার কারণে স্থানীয়দের যাতায়াত ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সস্তায় দখল করে নিয়েছে শ্রমবাজার। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টিরও বেশি অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত ২০১৭ সনের ২৫শে আগস্ট দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসব শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুযোগ সুবিধা পেলেও এভাবে অনিশ্চিত ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে চায় না রোহিঙ্গারা। আরসা নামক একটি উগ্রপন্থি সংগঠনের সদস্যরা সেনা ছাউনিতে হামলার অজুহাতে ২০১৭ সনের ২৫শে আগস্ট রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। দেশটির সেনা, বিজিপি, ও উগ্রবাদী রাখাইন যুবকরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা নর-নারীকে নির্যাতন আর হত্যা করে।