বিদায়ী বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন। এদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করেছেন। আর সবচেয়ে কম করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য বছর নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকলে বিদায়ী বছরে পুরুষ শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করেছেন। গতকাল আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে আত্মহত্যা, হতাশায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থীরা’- শীর্ষক সমীক্ষা সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
আঁল ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২১ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সমন্বয় করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যা মোট আত্মহত্যার ৬১.৩৯ শতাংশ। এ ছাড়াও মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
এটি মোট আত্মহত্যার ১১.৮৮ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যা মোট আত্মহত্যাকারীর ৩.৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার হার ২২.৭৭ শতাংশ। এই তথ্যমতে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ জন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩ জন আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় করে আঁচল ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ২২-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সের ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এটি মোট ঘটনার ৫৯.৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, ১৮-২১ বছর বয়সী তরুণদের আত্মহত্যার ঘটনা মোট সমন্বয়কৃত ঘটনার ২৬.৭৩ শতাংশ বা ২৭ জন। এ ছাড়া ২৬-২৯ বছর এবং ২৯ বছরের ঊর্ধ্বে এই হার যথাক্রমে ৯.৯০ শতাংশ এবং ৩.৯৬ শতাংশ। সংখ্যায় যথাক্রমে ১০টি ও ৪টি।
আঁচল ফাউন্ডেশন আরও জানায়, সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা গেলেও এবারের সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে দেখা যায়, গতবছর আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছিল পুরুষ শিক্ষার্থী। সর্বমোট ৬৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৪.৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৬ জন বা ৩৫.৬৪ শতাংশ। পুরুষ আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা নারীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। করোনার মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। মাসভিত্তিক আত্মহত্যা প্রবণতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় ডিসেম্বর মাসে এই হার সবচেয়ে বেশি ছিল যা সমন্বয়কৃত ঘটনার ১৪.৮৫ শতাংশ বা ১৫ জন এবং সবচেয়ে কম ছিল এপ্রিল মাসে যা ১.৯৮ শতাংশ বা ২ জন। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা যায়।
আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি আরও জানায়, অনার্স পড়ুয়া ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি যা ৩৬.৬৩ শতাংশ। ধারণা করা যায়, এই শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মধ্যে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে উঠে আসে সম্পর্কগত কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৪.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছে ১৯.৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০.৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং আর্থিক সমস্যাকবলিত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে আরও দেখা যায়, মাদকাসক্ত হয়ে নির্বিকারে নিজের জীবন হননের পথ বেছে নিয়েছে ১.৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আরও নানাবিধ কারণে আত্মহত্যা করেছেন মোট ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঁচল ফাউন্ডেশন কয়েকটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, প্রতিটি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল নিয়োগ দেয়া এবং ইয়্যুথ অর্গানাইজেশনকে যথাযথ ট্রেনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। পলিসি ডায়ালগে তরুণদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা পুরোপুরি দেশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ট্যাবু ও হীনমন্যতা দূরীকরণে প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহে জরুরিভিত্তিতে একটি জাতীয় হটলাইন সেবা চালু করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে সরকার একটি বিশেষ অ্যাপস চালু করতে পারে যেন যে কেউ দ্রুত মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারে। প্রান্তিক পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তরুণদেরকে মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড ট্রেইনিং সরবরাহ করা। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন আয়োজন করা। সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা জোরদার করা। মানসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ ফি ও ঔষধের দাম কমানো।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারায় আত্মহত্যা বেড়ে যাচ্ছে। পত্রিকা বিশ্লেষণ করে এটা স্পষ্ট যে, আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত তাই তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারে না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তারা যেমন ভেঙে পড়ে, তেমনি পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলও তাদেরকে আশাহত করে। দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরবর্তীতে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় দায়িত্বশীলদের অবদান রাখার সঠিক সময় এখনই।