তখনো তিনি ঘটনার আদ্যোপান্ত জানেন না। বাসায় পড়ার টেবিলে বসে আছেন। নিয়মিত মানবজমিন এ ‘চাচার পাঁচালি’ কলাম লেখেন, তা নিয়েই কাজ করছেন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে খুনসুটি করছেন সুযোগ পেলেই। ঠিক সে সময় এক বন্ধুর ফোন। অপরপ্রান্ত থেকে জোর গলায় সেই বন্ধু বলে ওঠেন, মাহবুব ঘটনাতো ঘইটা গেছে। কি হইছে? তুমি কমিশনার হইছো। মাহবুব তালুকদার তখনো কিছুই বুঝে ওঠতে পারেন নি। বললেন, ঘটনা কি, খুলে বলো? অপরপ্রান্তে লাইনে থাকা বন্ধুটি জানালেন, স্কয়ার হাসপাতালে ওয়েটিংয়ে বসে আছেন। দেখেন, টেলিভিশনে স্ক্রল যাচ্ছে, নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম চূড়ান্ত।
বিজ্ঞাপননামের তালিকায় যাদের দেখছেন তাদের মধ্যে তার নামও আছে। নড়েচেড়ে বসলেন মাহবুব তালুকদার। সেদিন এটি হয়তো প্রথম ফোন ছিল। তবে সেই যে শুরু এই ফোনটি আর বেশ ক’দিন বিশ্রাম পায়নি। দিনের আলো শেষে রাতের আঁধারেও ফোন বাজতেই থাকে। অভিনন্দনে সিক্ত হতে থাকেন মাহবুব তালুকদার। দেশ ও দেশের বাইরের অসংখ্য মানুষ তাদের শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছেন তাকে। শপথ নেয়ার পর আসে কঠিন সময়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ। প্রতি মুহূর্তেই অগ্নি পরীক্ষা। মানবজমিনকে দেয়া শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারার আক্ষেপ জানিয়ে বলেছেন, কষ্ট নিয়েই ফিরে গেছেন সাধারণের কাতারে। তবে প্রতি মুহূূর্তে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন। সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
একটা সময় একঘরে হয়ে পড়েন তিনি কমিশনে। কমিশনার থাকা অবস্থাতেই তিনি ভুগছিলেন জটিল শারীরিক সমস্যায়। বাইরে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। অনেকদিন চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরছেন। এয়ারপোর্টে নেমে হুইল চেয়ারে করে ফিরছেন। হঠাৎ একদল শ্রমিক মাহবুব তালুকদারের হুইল চেয়ার ঘিরে ধরে। তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে যান। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলেন এই মানুষগুলো তার জন্য প্রার্থনা করছেন। রোগমুক্তি চাইছেন। সকলেই সমস্বরে বলে উঠেছেন, আমরা আপনার জন্য সবসময় আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি, আপনি আমাদের সাহস। মধ্যপ্রাচ্যগামী এই শ্রমিকরা ওনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন। চোখ ভিজে যায় কান্নায়। তেমনই আরেক ঘটনা দাগ কেটেছে সদ্য প্রয়াত সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের। কমিশনার হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা একেবারেই কমে গেছে। একদিন নিজের একান্ত কিছু কেনাকাটার জন্য একটি মার্কেটে নামেন। পেছনে পুলিশ রয়েছে। অনেক মানুষের ভিড়ে এক ভিক্ষুক তার পথ আটকে দাঁড়ায়। পুলিশ মাহবুব তালুকদারকে সরিয়ে নিতে চাইলো। তিনি হাত দেখিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের থামিয়ে দিলেন। ভিক্ষুকের কাছে যেতেই অশীতিপর বৃদ্ধ জোর গলায় বলে ওঠেন, বাবা, আমি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। আমি সুযোগ পেলেই টিভিতে আপনার কথা শুনি। আপনি বাপের বেটা।
বাপের বেটার মতোই কাজ করছেন। প্রতিটি নির্বাচন শেষে মাহবুব তালুকদার স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। এজন্য সরকারি মহলে বিশেষত অনেক মন্ত্রীরা তার পদত্যাগও চেয়েছেন। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকেই আবার বলা হয়েছে, এটি তাদের একান্ত নিজস্ব মত। আপনি আপনার কাজ করে যান। এসবই কমিশনের ভেতর বাহিরের কথা। কিন্তু সব ছাপিয়ে মাহবুব তালুকদারের পরিচয় দিন শেষে তিনি একজন লেখক। নির্বাচন কমিশনে থাকাকালীন দিনগুলি নিয়ে প্রকাশিতব্য বই ‘নির্বাচননামা’ লিখে গেছেন। কমিশনে থাকাকালীন নানা ঘটনা ও নেপথ্যের ঘটনা সেই বইতে উল্লেখ করেছেন। শেষ বেলাতেও বইটি প্রকাশিত অবস্থায় দেখে না যাওয়ার আপসোস রেখে গেছেন। এর বাইরে নিজের লেখা গল্পগুলো নিয়ে দুটি বই প্রকাশের ইচ্ছাও পোষণ করেছেন তিনি। ইচ্ছা ছিল বই দুটি খ্যাতনামা দুজন সম্পাদককে উৎসর্গ করবেন। তাদের হাতে বই দুটি তুলে দেয়ার ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল মাহবুব তালুকদারের। একেবারে শেষ সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিজের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধ ও নিবন্ধমূলক লেখাগুলো এক মলাটে প্রকাশের কাজও শুরু করেছিলেন। কিছু এলোমেলো ইচ্ছেও ছিল মাহবুব তালুকদারের। গল্প আড্ডায় একদিন বলছিলেন, আমার অনেক বই জমা হয়ে গেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না।
বাসায় আর বই রাখার কোনো জায়গা নেই। জানালেন, কমিশন ছাড়ার সময় হাজার তিনেক বই নির্বাচন কমিশনের লাইব্রেরিতে দিয়ে এসেছেন। হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই বই থেকে উপকৃত হবে। এছাড়া বেশকিছু বইয়ের সংগ্রহ কয়েকটি লাইব্রেরিতে দিয়ে দেবেন ভাবছেন। আর একান্ত অবসর বলে কিছু নেই তাই আলসেমি কাটাতে ঢাকার জনাকীর্ণ কোনো স্থানে একটি পুরনো বইয়ের দোকান দেয়ার স্বপ্নও দেখেন মাঝেমধ্যে। যেখানে কফি থাকবে অফুরন্ত আর পৃথিবীর সেরা সব মূল্যবান বইয়ের সমাহার। লিখবেন, পড়বেন আর গল্প করবেন। জুন-জুলাইয়ে শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। মাঝখানে দেড় মাস ছিলেন ইউনাইটেড আর এভারকেয়ার হাসপাতালে। বাসায় ফিরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চেন্নাইতে যাওয়ার। কিন্তু পাসপোর্ট জটিলতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েন। কথা ছিল সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে যাবেন চেন্নাই। সেরেই ঢাকায় ফিরে অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। অসমাপ্ত কাজগুলো মাহবুব তালুকদারের আর দেখা হয়ে ওঠেনি।