‘রিয়া মনির বিয়েতে বেশি খুশি ছিলেন তার মা ফাহিমা বেগম। প্রতিবেশীদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আনন্দে নিজে মেহেদীর রংয়ে রাঙিয়েছিলেন দুই হাত। ঘটনার দিন স্বজনদের নিয়ে গিয়েছিলেন রিয়া মনির শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু, আনন্দের সেই যাত্রাই যে তার শেষ যাত্রা হবে কেউ ভাবতেই পারেননি। ফাহিমার সঙ্গে তার বোন ঝর্ণা ও তার দুই শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়েছে গার্ডার চাপায়। মৃত্যু হয়েছে রিয়া মনির বর হৃদয়ের বাবা রুবেল মিয়ার। পাঁচ পাঁচটি মৃত্যুতে হাহাকার চলছে দুই পরিবারে। সরজমিন ঢাকার আশুলিয়ার খেজুরবাগান ও দক্ষিণখানের কাওলার বাসায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এটি কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়।
বিজ্ঞাপনএটা হত্যাকাণ্ড। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে ৫টি প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। এ নিহত রুবেলের স্বজন আফসান মণ্ডল অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে গতকাল সকালে উত্তরা পশ্চিম থানায় হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেছে। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ। এদিকে, গার্ডার দুর্ঘটনায় ঠিকাদারের গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। গতকাল ওই স্থানে গার্ডার উঠানো নামানো বন্ধ ছিল। ওই পথ দিয়ে যাতায়াতকারীরা থমকে দাঁড়িয়ে ঘটনাস্থলটি দেখছিলেন।
গত সোমবার বিকাল ৪টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন জসিম উদ্দীন সড়কের প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে ক্রেন দিয়ে গার্ডার নামানোর সময় এটি পড়ে একটি প্রাইভেট গাড়ির উপর। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যায়। সেই গাড়িতে ছিলেন নবদম্পতি রিয়া মনি ও হৃদয়। এ ছাড়াও ছিলেন রিয়া মনির মা ফাহিমা বেগম। ফাহিমার বোন ঝরনা (২৮), ঝরনার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)। আর গাড়িটি চালাচ্ছিলেন রিয়ার শ্বশুর রুবেল মিয়া (৬০)। গার্ডারটি গাড়ির উপর পড়ার পর আশপাশের লোকজন কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া চাপা পড়া ওই গাড়ির সামনের বামপাশের সিট থেকে পথচারীরা রিয়া মনি ও হৃদয়কে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। গার্ডারটি অত্যন্ত ভারী হওয়ার কারণে বাকিদের উদ্ধার করতে পারেনি পথচারীরা। পরে ফায়ার সার্ভিস ৪ ঘণ্টা পর চাপা পড়া লাশ উদ্ধার করে। গতকাল সকালে খেজুর বাগানের আশরাফ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িতে লোকজনের ভিড়। ওই বাড়ির ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন রিয়া মনির মা ফাহিমা বেগম। ফাহিমা বেগমের এমন মৃত্যুতে ওই বাসার লোকজনের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ফাহিমার প্রতিবেশী আব্দুস সালাম জানান, রিয়া মনির মা ফাহিমা বেগম মেয়ের বিয়েতে অত্যন্ত খুশি ছিলেন। তিনি আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আলেয়া বেগম নামে আরেক প্রতিবেশী জানান, সোমবার দুপুরে মিষ্টি হাতে ফাহিমা বেগমকে যেতে দেখলাম। পরে সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম তিনি মারা গেছে। মিষ্টি হাতে ওই যাত্রা তার শেষ যাত্রাই পরিণত হলো। তিনি আরও জানান, সালমা বেগম খুব কষ্টে তার দুই ছেলে ও মেয়েকে পড়াশোনা করাতেন। তার ছোট ছেলে ফাহাদ মাদ্রাসায় আবাসিক থেকে পড়ালেখা করে। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার শফিকুল ইসলাম জানান, গত শনিবার রিয়া মনি ও হৃদয়ের বিয়ে হয়। সোমবার দুপুরে আশুলিয়ার ভাড়া বাসা থেকে মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিলেন রিয়ার মা ফাহিমা বেগম ও খালা ঝরনা বেগম। সঙ্গে ছিল ঝরনা বেগমের দুই শিশু সন্তান। পরে তাদের মৃত্যুর খবর পায়। তিনি আরও জানান, রিয়া মনির বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলে আমি তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করি। বিয়ের ঘরোয়া আয়োজনেরও ব্যবস্থা করে দেই বাড়ির ছাদে। অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে গ্রাম থেকে রিয়ার খালা ঝরনা ও তার দুই সন্তান জান্নাত ও জাকারিয়াকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। স্থানীয় পান দোকানি শহিদুল ইসলাম জানান, ফাহিমা বেগম মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিলেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এদিকে, গতকাল দক্ষিণখানের কাওলায় নিহত রুবেলের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, তার বাড়িতে লোকজনের ভিড়। সবুজ নামে রুবেলের এক প্রতিবেশী জানান, ওই ঘটনার পর এলাকার লোকজন রুবেলের বাড়িতে ভিড় করছেন।
এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. মহসিন মানবজমিনকে জানান, ‘ নিহত রুবেলে আত্মীয় আফসান মণ্ডল বাদী হয়ে থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে একটি মামলা করেছেন। ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ইতিমধ্যে থানা পুলিশের একটি তদন্তকারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আশপাশের লোকজনের তথ্য নিয়েছে। তিনি আরও জানান, সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা নবদম্পতি রিয়া মনি ও হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ। এ দুর্ঘটনায় কারও গাফিলতি থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে, গার্ডার দুর্ঘটনায় ঠিকাদারের গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। গত সোমবার জাতীয় শোক দিবসের ছুটির দিনে কাজ করার কথা না থাকলেও ঠিকাদার কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল বলে জানিয়েছেন সচিব। ঢাকার উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কংক্রিটের গার্ডার আছড়ে পড়ে হতাহতের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী গতকাল মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা, গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। দুর্ঘটনার দিন গত সোমবার কাজ করার কথা ছিল না।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল। পরে সন্ধ্যায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব আমিন উল্লাহ নূরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সরকারের তরফে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের কথা জানান। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি গতকাল প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জানান সচিব আমিন উল্লাহ নূরী। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকজ করবো। চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসলে সিদ্ধান্ত নেবো।