হিসাব মিলছে না মধ্যবিত্তের। নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ টিকে থাকতে লড়ছে। নিম্ন বিত্তের জীবন এখন চলছেই না। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় ত্রাহি অবস্থায় এই তিন ‘বিত্তের’ মানুষ। দিন, সপ্তাহ, মাস হিসাব করে চলা এই সব মানুষ টিকে থাকতে নানা পন্থা অবলম্বন করছেন। কেউ খরচ কমাচ্ছেন। কেউ পরিবার ছেড়ে একা থাকছেন। কেউবা ধারদেনায় ডুবছেন।
আরিফ হোসেন ভূঁইয়া। জাপানের একটি কোম্পানির বাংলাদেশ প্রধান হিসেবে কর্মরত। এয়ারকন্ডিশনের ব্যবসা করে কোম্পানিটি।
বিজ্ঞাপন
দেশে করোনার থাবায় তাদের ব্যবসায় ধাক্কা লাগে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। ৫-৬ জন কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হন। আশায় ছিলেন করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে ফের ব্যবসায় সুবাতাস লাগবে। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। বৈশ্বিক মন্দায় এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ধাপে ধাপে ফের কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। দেশে এখন তারা মাত্র ২-৩ জন কর্মরত আছেন। আরিফ হোসেন বলেন, খুব কঠিন জীবন যাচ্ছে। আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কাজের সময় বাড়িয়েছি। আরেকটা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তা থেকে এখনো আয় আসছে না। ব্যয় সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসিক এক যন্ত্রণায় আছি।
আরিফ হোসেনের প্রতি মাসে আয় ৮০ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে ঢাকায় একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। প্রতিমাসে আয়ের প্রায় অর্ধেক তার ফ্ল্যাট ভাড়াতেই চলে যায়। দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা দিয়ে বাজারসহ যাবতীয় খরচ বহন করেন। কিন্তু তা দিয়ে বাকি খরচ মেটানো যায় না। এজন্য ‘ম্যানেজ’ করে চলছেন। আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় খরচ হয় বাসা ভাড়ায়। শুধু সার্ভিস চার্জই ৫ হাজার টাকা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ৪০ হাজার টাকা বাসা ভাড়াতেই খরচ হয়ে যায়। বাজার খরচও বেড়েছে। আগে ৫ হাজার টাকায় যেসব বাজার করতাম এখন ১০ হাজার টাকাতেও সেই বাজার করা যাচ্ছে না। সবকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু আমার আয় কমছে। এখন খুব স্ট্রাগল করছি। মেয়ের লেখাপড়ার জন্য ব্যাংকের ঋণও নিয়েছি। এখন সে স্কলারশিপে মেডিকেলে পড়ছে। তাই খরচটা কমেছে। ছেলের জন্যও অনেক টাকা খরচ হয়। দুই ছেলেমেয়ের জন্য প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়।
‘ম্যানেজ’ করে চলার জন্য অনেক শখ-আহ্লাদ পূরণ বাদ দিয়েছেন আরিফ হোসেন। পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাওয়া বাদ দিয়েছেন। আত্মীয়রা সংকটে থাকলেও সহযোগিতা করার উপায় থাকে না তার। মন চায় বাইরে ঘুরতে যাই, ডিনার করি। কিন্তু এখন তা করতে পারি না। আগে আত্মীয়দের সহযোগিতা করতে পারতাম। এখন তাও করতে পারি না। আমরা সামাজিক অনুষ্ঠানে না গিয়েও পারি না। মান-সম্মানের বিষয় সামনে চলে আসে। অনেক ক্ষেত্রে ধার করে যেতে হয়। ম্যানেজ করে চলতে হয়। মানসিক চিন্তায় থাকি। পঞ্চাশোর্ধ্ব আরিফ হোসেন এর আগে কখনো এমন সংকট দেখেননি বলে জানান। বলেন, আমরা ছোট ছোট ক্রাইসিস দেখেছি। কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো বড় ক্রাইসিস দেখিনি। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত হয়ে আসছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আরও কঠিন অবস্থা তৈরি হবে। আমরা আরও বেশি সংকটে পড়ে যাবো।
পরিবার ছেড়ে ঢাকায় ফিরোজ হাওলাদার: দিনমজুর ফিরোজ হাওলাদার। কষ্টকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন। পরিবার ছেড়ে পড়ে আছেন ঢাকায়। থাকেন উত্তরার ১৮ নম্বরের একটি মেসে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে অন্ন জোটাতে গ্রাম ছেড়েছেন। এখন ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করেন। কষ্ট করে সংসার চালান। দিন যত গড়াচ্ছে ততই তার কষ্ট বাড়ছে। মলিন মুখে ফিরোজ বলেন, কষ্ট আগেও করছি। কিন্তু এখন কষ্ট আরও বাড়ছে। সবকিছুর দাম বেশি। চাল, ডাল, মাছের দাম বেশি। চিনির দাম বেশি। জীবন ধীরে ধীরে কঠিনের দিকে যাচ্ছে।
ফিরোজের আয়ের পথ একটাই। ব্যয় অনেক। পাঁচ জনের পরিবারের সংসার তার কাঁধে। ভোলার দৌলতখান থানায় থাকেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। ঢাকায় তার শরীরে ঘাম ঝরলে পরিবারের দু’বেলা খাবার জোটে। দিনমজুর ফিরোজ ৬০০-৬৫০ টাকায় রোজ কাজ করেন। সপ্তাহে ৪-৫ দিন তার কাজ হয়। সব মিলে মাসে ২০ দিনের মতো কাজ থাকে। এতে তার ১২-১৩ হাজার টাকা আয় হয়। এ ছাড়া আর কোনো আয় নেই। ফিরোজ জানান, দুপুরে তার হোটেলে ভাত খেতে ৮০-১০০ টাকা খরচ হয়। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার মিলে আরও ১৫০ টাকার মতো লাগে। সব মিলে তার প্রতিদিন ২৫০ টাকার খরচ হয়। মাসে ১৩ হাজার টাকা আয়ের মধ্যে ৭ হাজার টাকা তার ঢাকায় থাকা, খাওয়া বাবদ খরচ করতে হয়। বাকি ৫-৬ হাজার টাকা গ্রামে পরিবারকে দেন। এতেই চলে তাদের কষ্টের জীবন।
গত রোজার ঈদে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ফিরোজ। এজন্য ৩০ হাজার টাকা ধার করেছেন। সেই ঋণ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে। তার জন্য মাসে ২ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। সেই খরচও চালাতে পারেন না তিনি। ফিরোজ বলেন, বড় ছেলে খুব কষ্ট করে পড়ে। পড়ালেখার টাকা না খেয়ে হলেও দেয়ার চেষ্টা করি। আমি হোটেলে শাক, সবজি খাই। টাকা বাঁচাই। মাঝেমধ্যে কম দামি মাছ খাই। গরুর মাংস খাইতে গেলে ১৬০ টাকার বেশি লাগে। ৬ মাসে পারলে একবার খাই, না পারলে খাই না। এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। দেনায় পড়তে হয়। তিন-চার মাস ধরে ২০-৩০ হাজার টাকা দেনা হয়ে গেছি। এই টাকা কীভাবে দিবো সেই চিন্তায় আছি। সামনে আমার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আগে ৬০০ টাকা রোজ পাইতাম। এখনো তাই পাই। রোজ বাড়ে নাই। কিন্তু খরচ তো বাড়তাছে।
প্রতি মাসেই ধার করে চলেন বাদল: বাদল পেশায় গাড়িচালক। তার সংসারও চলছে টানাটানির উপর। প্রতি মাসেই ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেও ব্যয় কমাতে পারছেন না তিনি। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য আলাদা শিক্ষক দিয়েও পড়াতে পারছেন না। বাদল বলেন, আমার মতো গরিব মানুষের জীবন এখন অনেক কঠিন। মন চাইলেও ভালো কিছু কিনে খাইতে পারি না। বেতন বাড়ে নাই কিন্তু খরচ বাড়ছে।
গাড়ি চালিয়ে বাদল প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পান। সেখান থেকে ঘরভাড়া দেন ৭ হাজার টাকা। প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকার উপরে বাজার খরচ হয়। দুই মেয়েকে কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাদের পড়াতে ২ হাজার টাকা লাগে। তিনি বলেন, আগে মাসে ৬ হাজার টাকার বাজার করলেই হয়ে যেতো। এখন ৮ হাজার টাকাতেও হয় না। মালিক অতিরিক্ত নাস্তার টাকাও দেয় না। মেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে পারি না। এমনিই প্রতি মাসে ২-৩ হাজার টাকা ধার করতে হয়। বেতন পেয়ে তা শোধ করি। যা আয় হয় তার চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়।
বাদল জানান, খরচ সামলাতে অনেক কিছু খাওয়া বাদ দিয়েছেন। কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংসও কিনে খাওয়া হয় না। পরিবার নিয়ে গ্রামেও বেড়াতে যান না। পরিবার নিয়ে গ্রামে বেড়াতে গেলে ৫-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকা আমি কোথায় পাবো। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে। ঢাকায় থাকা কঠিন হচ্ছে। এখন আমাদের মতো মানুষের ঢাকা ছাইড়া গ্রামে চলে যাইতে হইবো। গ্রামে কৃষিকাজ করে চলতে হবে। ঢাকা গরিবের জন্য না। ঢাকা বড়লোকের জন্য।