ক্রমাগত বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যের দামে জেরবার মানুষ। নিত্যপণ্যের সঙ্গে বাড়ছে অন্যান্য সেবাপণ্যের দামও। সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানির উচ্চ মূল্য ও বাড়তি পরিবহন ব্যয়। এই অবস্থায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা ছোট করছে মানুষ। কমিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়। কাটছাঁট করতে হচ্ছে সন্তানের চিকিৎসার খরচ। খরচ কমিয়ে টিকে থাকার এই কৌশলও এখন আর কাজে আসছে না। কারণ ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো খরচ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী শফিকুল ইসলাম। ছয় মাস হলো বিয়ে করেছেন।
স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। দিন যত গড়াচ্ছে জীবনমান ততই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে তার। শফিকুল ২৫ হাজার টাকা বেতন পান। সংসার দু’জনের হলেও এই আয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টিকে থাকতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সব ক্ষেত্রেই।
বিয়ের পর দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন শফিকুল। প্রতিমাসেই ১০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়। ইন্টারনেট বাবদ দিতে হয় ৫০০ টাকা। চাল, ডাল, তেলসহ মাসে বাজার করতে সর্বনিম্ন ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ প্রতিমাসে ২২ হাজার টাকা শুধু এই দুই খাতেই খরচ। বেতনের বাকি থাকে তিন হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত বাবদ শফিকুলের ৩-৪ হাজার টাকা খরচ। মাসে একটি ২ হাজার টাকার সঞ্চয় রয়েছে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে আরও ২ হাজার টাকা। মাস শেষে বেতন পাওয়ার পর আয়-ব্যয় মেলাতে পারেন না শফিকুল।
শফিকুলের টিকে থাকার লড়াইয়ে জীবনযাপনের ধরন বদলাতে হচ্ছে। তিনি জানান, আগে প্রতিমাসেই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতেন। বিয়ের পর ৬ মাসে স্ত্রীকে নিয়ে মাত্র একবার ঘুরতে গিয়েছেন। আগে তার খাবার তালিকায় অধিকাংশ সময়ই মাংস থাকতো। কিন্তু এখন তা কালেভদ্রে কেনেন। মাছ কেনাও কমিয়েছেন। কমদামি সবজি আর শাক খাবার তালিকায় যোগ হয়েছে। মাঝেমধ্যে ডিম কিনেন। এতে খরচ কিছুটা কমলেও তা পর্যাপ্ত নয়। শফিকুল জানান, আগে অফিস শেষে প্রায় সময় রিকশায় চলতেন। কিন্তু এখন বাস আর হেঁটেই চলাচল করেন।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন। থাকতেন রাজধানীর নিকেতন আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায়। এখন তিনি পূর্ব বনশ্রী এলাকায় নতুন বাসা নিয়েছেন। নিকেতনের যে বাসায় থাকতেন সেটি ছিল ৪ কক্ষের। নতুন বাসাও ৪ কক্ষের, তবে ভাড়া অর্ধেক। অভিজাত এলাকায় অনেক বাসা ফাঁকা পেলেও ভাড়ার সঙ্গে নিজের হিসাব মেলাতে না পারায় তাকে একটু কমে বাসা ভাড়া নিতে হয়েছে।
স্ত্রী ও সন্তান আর মা-বাবাকে নিয়ে ঢাকার বাইপাইল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মাহমুদুল ইসলাম। বাইপাইল এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন । সম্প্রতি তিনি গ্রামে চলে গেছেন। মাহমুদুল বলেন, ঢাকায় সবকিছুর দাম বেশি হওয়ায় সংসারের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বাসা ভাড়ার পাশাপাশি যাতায়াত ভাড়াও বেড়েছে। নিত্যপণ্যের যে দাম, তাতে পোষাতে না পেরে বাধ্য হয়ে গ্রামে এসে মুদি দোকান দিয়েছি। সরকার টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল, চিনি দিচ্ছে। কিন্তু এই তেল, ডাল, চিনি দিয়ে তো একটি পরিবারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভবপর নয়।
স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনার পর ঢাকায় বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। কিন্তু স্বল্প বেতনে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। দিনে ৭০০-৮০০ টাকা ভাড়া পাই, গ্যাস খরচ বাদ দিয়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা হাতে থাকে। এই টাকা দিয়ে দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ ৪ জনের সংসার চালানো খুবই কষ্টকর।
একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন শামসুল হক। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই সন্তানের পড়াশোনা, নিজের চিকিৎসা, অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে অতিকষ্টে জীবন চলছে আমার। পরিবারের খরচ মেটাতে একটি এনজিও থেকে ঋণ করেছি। কারও কাছে মুখ ফুটে অভাবের কথা বলতেও পারি না, সইতেও পারি না।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা অমল কান্তি দাস। মধুবাগ বাজারের পাশে মুচির কাজ করেন। প্রতিদিন শ্রম দিয়ে দিনে ৪০০ টাকা আয় করেন। আগে যেখানে হাজার টাকার মতো আয় করতেন। বর্তমান এই আয় দিয়ে ৩ কেজি চাল, তেল, কাঁচাবাজার বাবদ এবং ৪ সন্তান ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ৬ জনের সংসারে দিনে তার ব্যয় হয় ৪০০ টাকার উপরে। এই ঘাটতি তিনি মেটান মাঝে মাঝে ঋণ করে।
অঞ্জলি হাজরা সিনিয়র হেড নার্স হিসেবে অবসর নিয়েছেন দু বছর আগে। পেনশন আর অবসরকালীন টাকা ব্যাংকে রেখে যে মুনাফা পেতেন তা দিয়ে আগে ভালোই চলতো তার সংসার। আর এখন খরচের লাগাম টানার চেষ্টা করছেন। অঞ্জলি বলেন, পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় সেই যে তরুনী বয়সে চাকুরীতে যোগ দিয়েছি তখন থেকেই সংসারের দায়িত্ব আমার। একারণে নিজের বিয়ের কথাও কখনও ভাবিনি। তখন অল্প বেতন পেতাম তারপরও সংসার চালাতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু এখন সত্যিই হিসেব মিলাতে পারছি না। আমার ভাইয়ের দুই মেয়ে জ্যোতি ও পূজা ওরাই আমার সন্তান। ওদেরকে নিয়ে আমি ঢাকায় থাকি। পরিবারের বাকী সদস্যরা থাকে গ্রামের বাড়ীতে। জ্যোতি পড়ে একটি বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ে। এক সেমিস্টারে তার খরচ প্রায় পনের হাজার টাকা। পূজা তেজগাঁও কলেজে এইচএসসি ২য় বর্ষে পড়ে। তার কলেজের বেতন এক হাজার টাকা। এছাড়া প্রাইভেট খরচ বাবদ আরো তিন হাজার টাকা। বাড়ী ভাড়া একুশ হাজার টাকা। আগে এসব টাকা পরিশোধের পর পাঁচ হাজার টাকায় মাছ মাংস ডিম তেল সাবানসহ যাবতীয় খরচ করলে সংসার ভালোভাবে চলে যেত। ভালো খেতে পারতাম আর এখন বাজারে গেলে কেমন যেন অসহায় লাগে। খুব চেষ্টা করি এক থেকে দেড় কেজি তেলে মাস পার করতে। তিন বেলার খাবার দু বেলায় নামিয়ে এনেছি। আমাদের বাসায় কোন নাস্তা হয় না।